শাপে বর

শাহীন আবদুর রহমান ◑
————————————

একজন পরিচিত আত্মীয় সম্পর্কিত লোকের ফোনে মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেল।

ভাবলাম সিরিয়াস কোন ফোনকল।

ঘুমাচ্ছিলেন মনে হয়! -রিসিভ করতেই তিনি বললেন।

এতোরাতে আর কি করবো ভাই। কি সমস্যা বলেন -আমি জবাব দিলাম।

জানালেন, তিনি নিয়মিত ইন্ডিয়া গিয়ে চিকিৎসা করান। করোনার কারণে এখন তো আর কোনভাবেই যেতে পারছেন না। এদিকে ইন্ডিয়া থেকে আনা সব ওষুধ ও শেষ। তাই বাধ্য হয়ে এখন বাংলাদেশী ওষুধ খাওয়া লাগবে। কি করা যায়?

আমি বললাম, ঠিক আছে সব ওষুধ নিয়ে হাসপাতালে বা চেম্বারে আসেন। বাংলাদেশী কি ওষুধ খাওয়া লাগবে ঠিক করে দিব।

বিকালে তিনি চেম্বারেই আসলেন। সিরিয়াল ব্রেক করে আত্মীয় হবার আবদারে ঢুকে পড়লেন। দূর থেকে আসা সিরিয়ালের রোগীদের মাঝে অসন্তোষের গুঞ্জন শোনা গেল।

একগাল হেসে তিনি ওষুধ বের করতে করতে জানালেন একগাদা ওষুধ দেয় বাংলাদেশী ডাক্তারেরা (ওষুধ কোম্পানির কমিশন খেয়ে)। অথচ দেখেন কতো কম ওষুধ দিয়েছে ইন্ডিয়ান ডাক্তারেরা!

আমি কিছু বললাম না। দেখলাম মোট পাঁচটা ওষুধ দিয়েছে ইন্ডিয়ান ডাক্তার। আত্মীয় ডাক্তার হিসেবে এখন আমার দায়িত্ব হচ্ছে এগুলোকে বাংলা তরজমা করা, চিকিৎসা প্রদান করা নয়।

আমি তা-ই করলাম। মোট ১৩ টা ওষুধ হলো।

ওনার তো তখন মাথা খারাপ অবস্থা।
এত্তগুলা ওষুধ! -তিনি আতংকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

আমি বললাম জ্বি, আপনার ইন্ডিয়ান ওষুধের একটার ভেতর দুইটা তিনটা করে ওষুধ আছে, আমার কিছু করার নাই।

তিনি অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।

আমি তখন চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম, এই লোক আজ থেকে পাঁচ বছর আগে আমার কাছে সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে এসেছিলেন ফ্রি ওষুধের জন্য। বাংলাদেশের ফ্রি ওষুধগুলা নাকি অসম্ভব রকমের ভাল। তাই উনাকে যদি দয়া করে কিছু প্যারাসিটামল আর গ্যাস্টিক এর ওষুধ লিখে দিই তাহলে উনার খুব উপকার হয়।

ঐসময় অবশ্য উনার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল, তাই ফ্রি ওষুধে কাজ হতো, এখন আর হয়না।

সম্ভবত ফ্রি ওষুধগুলো বাংলাদেশের কোটি কোটি গরীব কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকের জন্যে তৈরি। তাই উনার মতো উচ্চবর্গের লোকের আজকাল বাংলাদেশী সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের চিকিৎসায়ও কাজ হয়না। গত কয়েক বছরের ব্যাবধানে তিনি যে আংগুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন।

উনার মতো আরেকজন পরিচিত রোগী আমাকে জানিয়েছিলেন কলকাতার এক ডাক্তার নাকি উনাকে কচুর লতি খেতে দিয়েছেন শুধুমাত্র, আর তাতেই উনি ভাল হয়ে গিয়েছিলেন, পেটের সমস্যা আর নেই। অথচ বাংলাদেশে এমন কোন জায়গা নেই তিনি যাননি।

আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কচুর লতি কি আপনি জীবনে এই প্রথমবারের মতো খেয়েছেন, আগেওতো খেয়েছেন, তখন কেন ভাল হননি?

সমস্যাটা আসলে আপনার মনের ভেতরে, মাথার ভেতরে, পেটে নয়।

ইন্ডিয়া নিঃসন্দেহে আমাদের চেয়ে উন্নত দেশ। কিছু কিছু স্পেশালিটিতে এরা আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে, কোন সন্দেহ নেই। আর এটাইতো স্বাভাবিক। এরা অর্থনৈতিকভাবে আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত।

আমি এদের সমালোচনা ও করছিনা। এটা অনেকটা আত্মসমালোচনা। লোকজন টাকা পয়সা হলে কেন ইন্ডিয়া যায়?

কিংবদন্তি সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ তার একটা বইতে লিখেছিলেন, দাদারা নাকি এমনভাবে চামড়া ছিলে, মনে হবে যেন ম্যাসেজ করছে!

ঘটনা কিন্তু অনেকটাই সত্য। তাদের মুখের বচন অতীব সুমিষ্ট। অন্যদিকে বাংলাদেশী অন্যান্য যে কোন পেশার লোকের মতো বাংলাদেশী ডাক্তারদের অনেকেরই কর্কষ কন্ঠস্বর, কথাবার্তা সুন্দর নয়। আমরা অনেকসময় ঠিকমতন রোগীকে সময় দিইনা, অনেকসময় কাউন্সেলিং ও করিনা, বুঝিয়ে বলিনা রোগীকে।

অতিরিক্ত রোগীর চাপও এর জন্যে দায়ী। কিছু কিছু রোগী অনেকটা বিরক্ত হয়ে ইন্ডিয়া বা অন্যদিকে চলে যায়। অথচ অনেক ভাল ডাক্তার, অনেক লিজেন্ড আমাদের দেশেই আছেন, আমরা তাদের সন্ধান পাইনা বা দেখাইওনা অনেকসময়।

সমস্যা আরো আছে। আমাদের রোগীদেরও অনেক সমস্যা। আমরা সামান্য সর্দি কাশির জন্যেও বড় বড় প্রফেসরের সিরিয়াল দিয়ে বসে থাকি। ফলে যেই রোগীর আসলে ঐ প্রফেসরকে দেখানো প্রয়োজন তিনি সিরিয়াল পান তিন মাস পরে। তাই অনেকসময় বিরক্ত হয়ে তিনি ইন্ডিয়া চলে যান। যাদের সামর্থ্য আরো বেশি তারা ব্যাংকক কিংবা সিংগাপুর চলে যান।

এসব রোগী বিদেশে গেলে আবার তাদের নিয়ম কানুন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন, কোন গ্যাঞ্জাম করেন না, জোর করে হাসপাতালেও ঢুকতে চাননা।

একজন রোগী আমাকে এসে বললেন, তিনি তার ভাইকে নিয়ে টানা আটদিন ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ছিলেন। অত্যন্ত ভাল চিকিৎসা। সমস্যা হলো ছুটি হবার আগ পর্যন্ত একবারের জন্যও তিনি সেখানে ঢুকতে পারেননি, ভাইয়ের সাথে দেখা করতে পারেননি। আমি স্বান্তনার সুরে বললাম, আপনি আপনার পরিচয় দেননি? আপনার পরিচয় এবং কোন এলাকায় আপনার বাড়ি এসব জানতে পারলে নিশ্চয়ই তারা আপনাকে ঢুকতে দিতেন। তিনি খানিকটা বিব্রত হলেন।

আজকাল অবশ্য মাউন্ট এলিজাবেথ এ মৃত্যুবরন করাটা ও একটা ফ্যাশন কিংবা ডিগনিটির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে মৃত্যুবরন করলে তো আর মান সম্মান থাকে না। রীতিমতো প্রেস্টিজ এর ব্যাপার। অনেকের এটা আবার পারিবারিক ঐতিহ্য। আমাদের সংগে দেখা হলেই বুক ফুলিয়ে বলেন এটা।

যা-ই হোক, মূল কথায় আসি।

করোনা পরিস্থিতির কারণে সেই সুযোগ কিন্তু আর নাই। ঐসব দেশে গিয়ে চিকিৎসা নেয়া কিংবা মৃত্যুবরনের সৌভাগ্য লাভ করা এখন অসম্ভব। নিরাপত্তাহীনতার কারণে প্রাইভেট চেম্বারগুলিও আজ সংকুচিত। তাই সরকারি হাসপাতালই একমাত্র ভরসা।

আমরা ডাক্তাররা উভয়সংকটে থাকি সবসময়। আগে প্রাইভেট চেম্বার করার কারণে আমরা ছিলাম লোভী – কসাই। ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র‍্যাক্টিস এর বিরুদ্ধে আন্দোলন ও হয়েছিল। কিন্তু এখন করোনা আসার পর যারা চেম্বার করছেন না তারা আবার হয়ে গেলেন অমানুষ। তার মানে চেম্বার করলে লোভী, না করলে অমানুষ। আমাদের আসলে কোন নিস্তার নাই।

করোনার এই সময়ে সবচেয়ে পজিটিভ দিক হলো আমরা সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে আমাদের কি কি ঘাটতি আছে তা স্পষ্টতই বুঝতে পারছি এবং চেষ্টা করছি তা কাটিয়ে উঠার। অনেক সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে নিঃসন্দেহে এবারে আমাদের হেলথ্ সিস্টেম আরো উন্নত হবে এমনটাই আশা করা যায়।

এইসময় বাইরে যাবার কোন সুযোগ নাই। তাই সবাই নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই চেষ্টা করছেন স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের জন্য, ব্যাক্তিগত কিংবা সামষ্টিক পর্যায়ে। লকডাউন এর কারণে মুভ করা কষ্টকর হওয়ায় নিজ এলাকায় বেসিক ফ্যাসিলিটি থেকে শুরু করে আইসিইউর মতো ক্রিটিকাল ফ্যাসিলিটি ডেভেলপ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন আনেকে -যেটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।

তাই এই প্যারামিটারে বলা যায়, করোনা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্যে ‘শাপে বর’।